হযরত ঈসা আঃ কতৃক এন্তাকিয়া শহরে দাওয়াতের জন্য দুই ব্যক্তি প্রেরণ ও হাবীবে নাজ্জার এর ঘটনা

ওয়াহাব ইবনে মুনাব্বিহ (রঃ) বর্ণনা করেন, হযরত ঈসা আলাইহিস্সালাম দুই ব্যক্তিকে এন্তাকিয়া শহরে সত্যের দাওয়াত দিতে প্রেরণ করেণ। এই জনপদের রাজার নাম ছিল আনতাফাস। সে ছিল মূর্তি পূজক। ঐ দুই ব্যক্তি এন্তাকিয়া পৌঁছলেও রাজার নিকট যেতে পারেনি। অনেক দিন তাদের অপেক্ষা করতে হয়েছে। একদিন রাজা শহরে বের হলো, তারা উভয় উচ্ছঃস্বরে আল্লাহু আকবার বলেন। উচ্ছ স্বরে আল্লাহু আকবার জিকির করায় রাজা রাগান্নিত হয়ে তাদের কে গ্রেফতার ও একশত বেত্রাঘাত করার আদেশ করেন। যখন তাদের উভয়কে মিথ্যাজ্ঞান করা হয় এবং তাদের কে প্রহার করা হয় তখন হযরত ঈসা (আঃ) তার অনুসারীদের নেতা শামউন কে তাদের সাহায্যার্থে প্রেরন করেন। ছদ্মবেশে শামউন সে জনপদে হাজির হলেন, রাজার নিকটস্থ লোকদের সঙ্গে তার যোগাযোগ হয় এবং তাদের মাঝে তিনি জনপ্রিয় হয়ে উঠলেন। তখন তারা রাজাকে শামউনের ব্যাপারে অবহিত করল। রাজা শামউন কে দরবারে ডেকে পাঠালে তিনি হাজির হলেন। শামউনের সঙ্গে আলোচনায় রাজা মুগ্ধ হলো এবং তার যতাচিত সম্মান করলো। কিছু দিন পর শামউন রাজাকে বললেন, আমি জানতে পেরেছি যে, দুই ব্যক্তিকে আপনি কারাবন্দি করে রেখেছেন, তারা যখন আপনার ধর্মের বিরোধী কথা বলেছে তখন আপনি তাদের কে প্রহার করেছেন এবং বন্দি করেছেন। আপনি তাদের সঙ্গে কোন কথা বলেছিলেন? বাদশা বলল, আমি এত বেশি রাগান্নিত হয়েছিলাম যে, তাদের সঙ্গে কোন কথাই বলতে পারিনি। তখন শামউন বলল, রাজা যদি সমীচীন মনে করেন তবে তাদের কে তলব করে জিজ্ঞাসা করতে পারেন। শামউনের পরামর্শে রাজা ঐ দু’জন বাণীবাহক কে তলব করল, শামউন তাদের কে জিজ্ঞাসা করলেন, তোমাদেরকে কে এখানে পাঠিয়েছেন? তারা জবাব দিলেন আল্লাহ তা’য়ালা, যিনি সমস্ত কিছু সৃষ্টি করেছেন তার কোন শরীক নেই, শামউন তাদের কে বললেন, আল্লাহ তা’য়ালার গুনাবলি সংক্ষেপে বর্ননা কর। তারা বলল, তিনি যা ইচ্ছা তা করেন, তার যেমন মর্জি হয় তেমনি আদেশ দেন। শামউন বলেলন, তোমাদের নিকট কোন নিদর্শন রয়েছে? তারা বলল, যে কোন নিদর্শন ইচ্ছা তলব করতে পারেন। একথা শ্রবণ করা মাত্র রাজা এমন ছেলে কে ডেকে আনলো যার চক্ষুর কোন নমুনা ছিল না। কপাল যেমন সমান চক্ষুর স্থানও তেমন সমান। তখন ঐ দুই ব্যাক্তি আল্লাহর দরবারে দোয়া করতে লাগলেন, অবশেষে ঐ ছেলেটির চক্ষুর স্থান ফেটে গেল এবং একটু পরে সে চক্ষুষ্মান মানুষ হয়ে গেল। রাজা অত্যান্ত আনন্দিত ও আশ্চার্যন্বিত হলো। শামউন রাজাকে বললেন, যদি আপনি আপনার উপাস্যকে এরূপ করতে বলেন, আর উপাস্য যদি এরূপ করতে পারে, তবে আপনার প্রধান্য বিস্তার হবে, রাজা বলল, তোমার কাছে তো কোন কিছু গোপন নেই, আমরা যে সব মুর্তি পুজা করি তারা কোন কিছু শোনেও না, কোন কিছু দেখেও না, কোন প্রকার ক্ষতি কিংবা উপকার কিছুই করিতে পারে না। রাজা যখন মুর্তি পূজা করত এবং আল্লাহ তা’য়ালার দরবারে কাকুতি মিনুতি করতে থাকতো। লোকেরা মনে করত শামউন তাদের ধর্মে রয়েছে। এরপর রাজা ঐ দুই জন বানীবাহক কে বলল, তোমাদের খোদা যদি মৃতকে জীবিত করতে পারে, তবে আমি তাকে মানবো, তারা বললেন, তিনি সর্বসময় সর্বময় ক্ষমতার অধিকারী। তখন রাজাএকটি শিশুর লাশ হাজির করলো, যার মৃত্যু হয়েছিল এক সপ্তাহ পূর্বে। এই কারণে মৃত্যু লাশটি বিকৃত হয়ে গিয়েছিলো। এমন অবস্থায় তারা আল্লাহ তা’য়ালার দরবারে প্রকাশ্যে দোয়া করলো, আর শামউন চুপিসারে দোয়া করতে থাকলেন। কিছুক্ষন পরই মৃত শিশুটি জীবিত হয়ে বসে পড়লো এবং বলল, মুশরিক অবস্থায় আমার মৃত হয়েছিল সাত দিন পূর্বে। আমাকে অগ্নীর সাতটি ময়দানে নিয়ে যাওয়া হয়। আমি তোমাদের কে শিরক পরিত্যাগ করার কথা বলছি। তোমরা এক আল্লাহর প্রতি ঈমান আন। এরপর সে বলছে আসমানের দরজা খোলা হয়, আর আমি একজন অতি সুন্দর যুবককে দেখেছি যে, এই তিনজনের সুপারিশ করছে। রাজা জিজ্ঞাস করলো ‘তিনজন’ কে? সে বললো শামউন এবং এই দু’জন, রাজা অত্যান্ত বিস্মিত হল । শামউন যখন দেখলেন যে, এ ঘটনা রাজার মনে বিশেষ প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করেছে তখন তিনি রাজাকে বললেন, আপনি এ দুই ব্যক্তিকে বলুন, তারা যেন আপনার মৃত কন্যাকে জীবিত করে দেয়। রাজা তাই করলো, বানী বাহকদ্বয় সঙ্গে সঙ্গে নামাজ আদায় করলো এবং আল্লাহর কাছে দোয়া করলো। কিছুক্ষণ পরেই আল্লাহ তা’য়ালা রাজার মৃত কণ্যাকে জীবিত করে দিলেন। কবর ফেটে গেলো। মেয়েটি বের হয়ে এলো এবং বললো, আপনারা নিশ্চিত ভাবে জেনে রাখুন এ দুই ব্যাক্তি সত্যবাদী। তবে আশংকা আপনারা তাদের কথা মানবেন না। এরপর সে তাদের কে অনুরোধ করলো যে, আমাকে ফেরত পাঠিয়ে দিন, তখন তারা তাকে কবরে পাঠিয়ে দিল। ইবনে ইসহাক কাব এবং ওয়াহাব (রঃ) এর সূত্রে বর্ণনা করেছেন, রাজা শেষ পর্যন্ত ঈমান আনেনি। আর তার জাতিও ঈমান আনেনি। এরপর রাজা উভয় রাসুল কে হত্যা করার ইচ্ছা করলো। এ খবর পেয়ে বৃদ্ধ হাবিব দ্রুত বেগে এসে রাজা এবং তার পরিষদের উপদেশ দিয়েছে। এই হাবিবে নাজ্জার তিনি ছিলেন অত্যান্ত বেকার ব্যক্তি, শহরের এক প্রান্তে নির্জনে থেকে আল্লাহ তা’য়ালার বন্দেগীতে মশগুল থাকতেন। রাসুলগণের সঙ্গে কাফেরদের দুর্বব্যবহার দেখে তিনি নীরব থাকতে পারলেন না। তাই তাদের সাহায্যে ছুটে আসেন। এবং তাদের অনুসরনের জন্য তার সম্প্রদায়ের প্রতি আহবান জানালেন এবং তিনি বললেন “তোমরা অনুসরন কর এমন লোকদের যারা তোমাদের নিকট কোন প্রতিদান চায় না।এবং যারা হেদায়েত প্রাপ্ত যারা সঠিক পথের দিশারী”। কোন কোন বর্ণনায় আছে, হাবিবে নাজ্জার যখন লোকদের কে রাসুলগণের অনুসরণের আহবান জানাল তখন লোকেরা তাকে পাকড়াও করে বাদশাহের নিকট নিয়ে যায়। বাদশাহ তাকে জিজ্ঞাসা করল তুমি কি রাসুলগণের অনুসারী হয়েছে? তখন তিনি বাদশার প্রশ্নের জবাব দিলেন, বলেন ……… (অর্থঃ যিনি আমাকে সৃষ্টি করেছেন তার ইবাদত করব না, তবে কার ইবাদত করব? অথচ আমাদের এবং তোমাদের সবাইকেই তার নিকট ফিরে যেতে হবে।) এরপর হাবিবে নাজ্জার সকলের সম্মুখে দৃপ্তকন্ঠে ঘোষণা করলেন, তোমরা সকলেই স্বাক্ষী থাক আমি এক আল্লাহর উপর ঈমান এনেছি। হযরত আব্দল্লাহ ইবনে আব্বাস(রাঃ) বলেন- হাবিবে নাজ্জার এ কথাটুকু বলতে পেরেছিলেন, এরই মধ্যে দুরাত্মা কাফেররা তকে প্রহার করতে শুরু করে দেয়, এবং এক পর্যায়ে তাকে ধরাশায়ী করে পদদলীত করে। হযরত ইবনে মাসউদ (রাঃ) বলেন, তাকে এত নৃশংসভাবে হত্যা করা হয় যে, তাঁর নাড়িভুঁড়ি পর্যন্ত বের হয়ে গিয়েছিল। যখর কফেররা তার প্রতি প্রস্তর নিক্ষেপ শুরু করে, আর ঐ অবস্থায় তিনি বলেছিলেন হে আল্লাহ আমার জাতিকে হেদায়াত কর। হাসান বসরী (রঃ) বলেন তার ঘাড় কর্তন করে শহরের ফটকের সম্মুখে ঝুলিয়ে দেওয়া হয়, তার কবর এন্তাকিয়া শহরে রয়েছে। তার শাহাদাতের সঙ্গে সঙ্গে আল্লাহ তা’য়ালার পক্ষ থেকে তাকে জান্নাতের সুসংবাদ জানানো হয়, ‘তাকে বলা হলো তুমি জান্নাতে প্রবেশ করো’।
সুবহানাল্লাহ! কত আশ্চর্যের বিষয় হাজারো অত্যাচারের পরেও তার সম্প্রদায়ের হিতাকাংক্ষা তার হৃদয়ে কত বদ্ধমুল ছিলো। এরা আল্লাহর এমন বস্তু যা সম্প্রদায়ের চেহারা পাল্টে দিয়েছে। কুফুর ও পথভ্রষ্টতা হতে বের করতে সম্প্রদায় কে এমন মর্যাদায় প্রতিষ্ঠিত করেছে যার কারণে ফেরেশতাগনও তাদের প্রতি ঈর্ষান্নিত হয়ে পড়েছিল। শেষ কথা হলো বর্তমানের দ্বায়ীও মুবাল্লিগগণ যদি এভাবে ধৈর্যের সাথে দীনের কাজ আঞ্জাম দিতে পারেন, তবে আজও পৃথিবীতে দ্বীনের প্রসার তেমনি ভাবে হবে। যেমনি ভাবে নবী রাসূলগণের যুগে হয়েছিল। হে আল্লাহ তুমি আমাদের সে দলের পথে চলার জন্য তাওফীক দান কর। আমীন।

This entry was posted in কোরআনের গল্প. Bookmark the permalink.
//