চেয়ারে বসে নামায

প্রশ্ন: প্রকৃতপক্ষে কার জন্য চেয়ারে বসে নামায পড়া সঠিক?
উত্তর : যে ব্যক্তি দাড়িয়ে নামায আদায় করতে অক্ষম তার জন্য বিকল্প পদ্ধতি হল, জমিনে বসে তা আদায় করা। আর যে রুকু সিজদা করতে অক্ষম তার জন্য বিকল্প পন্থা হল, ইশারায় তা আদায় করা। আর যে ব্যক্তি যমিনে বসে নামায আদায় করতে অক্ষম তার জন্য বিকল্প হল, চেয়ারে বসে নামায আদায় করা। কেবলমাত্র প্রথম ও দ্বিতীয় ওযরের কারণে চেয়ারে বসে নামায আদায় করা ঠিক নয়। সারকথা হল, চেয়ারে বসে নামায আদায় করবেন শুধু ঐ লোকেরা যারা জমিনে বসে নামায আদায় করতে অক্ষম। (দেখুন : আল কাউসার)
প্রশ্ন: রুকু সিজদা করতে অক্ষম ব্যক্তিগণ জমিনের উপর বসে ইশারায় নামায আদায় করতে সক্ষম হওয়ার পরও যদি চেয়ারে বসে নামায আদায় করে থাকেন, তাহলে নামায হবে কি না?
উত্তর : রুকু সিজদা করতে অক্ষম ব্যক্তিগণ জমিনের উপর বসে ইশারায় নামায আদায় করতে সক্ষম হওয়ার পরও যদি চেয়ারে বসে নামায আদায় করে থাকেন, তাহলে সেটাও জায়েয, কিন্তু অনুত্তম কাজ। আর দারুল উলূম দেওবন্দের ফতওয়ায় এটাকে মাকরুহ বলা হয়েছে। মোটকথা, রুকু সিজদায় অক্ষম ব্যক্তিগণ জমিনে বসতে সক্ষম হলে তারা বসে বসে ইশারায় নামায আদায় করবেন। তাদের জন্য চেয়ারে বসে নামায আদায় করা মাকরূহ। যা পরিহার করা জরুরী। আর রুকু সিজদায় সক্ষম ব্যক্তি যদি এমনটি করে তাহলে তো তার নামাযই শুদ্ধ হবে না।(দেখুন : আল কাউসার)
প্রশ্ন: যে ব্যক্তি জমিনের উপর সিজদা করতে অক্ষম সে যদি চেয়ারে নামায আদায় করে তাহলে সে কিভাবে সেজদা করবে? শুধু ইশারার মাধ্যমে না সামনে তখতা, টেবিল বা অন্যকিছু রেখে তার উপর সিজদা করবে?
উত্তর : যে ব্যক্তি জমিনে সিজদা করতে অক্ষম তার ব্যপারে হুকুম হল, সে ইশারায় সিজদা আদায় করবে। এমন মাযূর ব্যক্তি যদি অন্য কোন কারণে চেয়ারে বসে নামায আদায় করেন তাহলেও তিনি ইশারায়ই সিজদা করবেন, সামনে তখতা বা টেবিল রেখে তাতে সিজদা করার প্রয়োজন নেই। যদি কেউ এমনটি করে তা সিজদা বলে গণ্য হবে না। অবশ্য এর দ্বারা যেহেতু ইশারার কাজ হয়ে যায় ফলে তার সিজদা আদায় হয়ে যাবে।
চেয়ারে বসে সামনে তখতা বা টেবিল ইত্যাদির উপর কপাল রাখাকে দুই কারণে সিজদা বলা সহীহ নয়। ১. সিজদার জন্য শর্ত হল, উভয় হাঁটু জমিনের উপর রাখা। ২. সিজদার সময় কপালের অংশ কোমরের অংশ থেকে নীচু থাকা দরকার। চেয়ারে বসে সামনের কোন কিছুর উপর কপাল রাখলে উল্লিখিত উভয় শর্ত পাওয়া যায় না। সুতরাং সেটাকে হাকীকী সিজদা (নিয়মতান্ত্রিক সিজদা) বলা ঠিক নয়। (দেখুন : আল কাউসার)

প্রশ্ন: যে ব্যক্তি দাড়িয়ে নামায পড়তে সক্ষম কিন্তু রুকু সিজদা করতে সক্ষম নয়, অথবা রুকু করতে সক্ষম কিন্তু সিজদা করতে অক্ষম। আমরা জানি, এই ব্যক্তি দাড়িয়ে বা বসে যেভাবে ইচ্ছা নামায আদায় করতে পারবে। কিন্তু উত্তম হল, এই ব্যক্তি বসে নামায আদায় করবে এবং ইশারায় রুকু সিজদা করবে। কিন্তু এক্ষেত্রে একটি বিষয়ে একটু খটকা লাগছে। তা হল, যে ব্যক্তি দাড়িয়ে নামায আদায় করতে সক্ষম তার দাড়িয়েই নামায আদায় করা উচিত। রুকু সিজদা করতে সক্ষম নয় তো রুকু সিজদা ইশারায় আদায় করবে। কিন্তু ‘কিয়াম’ (দাড়ানো) কেন ছেড়ে দেবে? এই মাসআলায় কি ফিকহে হানাফীতে শুধু একটিই ‘কওল’ (মত) নাকি অন্য ‘কওল’ও আছে? যদি থাকে তাহলে দলীলের আলোকে কোনটি বেশি মজবুত?
উত্তর : যে ব্যক্তি জমিনে সিজদা করতে সক্ষম নয় তার ব্যাপারে হানাফী ফকীহগণের প্রসিদ্ধ মত ওটাই যা আপনি জানেন যে, ‘‘এমন ব্যক্তির উপর দাড়িয়ে নামায আদায় করা জরুরী নয় বরং সে বসে ইশারায় নামায আদায় করবে।’’
এ বক্তব্যটি যদিও একেবারে দলীলবিহীন নয়, কিন্তু অনেক মুহাক্কিক ফকীহের দৃষ্টিতে এই মাসআলায় দলীলের বিচারে ফিকহে হানাফীর ঐ বক্তব্য বেশি শক্তিশালী যা ইমাম আবু হানিফার রাহ. শাগরিদ ইমাম যুফার ইবনে হুযাইল রাহ.-এর মাযহাব। আর এটাই বাকী তিন ইমামের (ইমাম মালেক রাহ., ইমাম শাফেয়ী রাহ. এবং ইমাম আহমাদ ইবনে হাম্বল রাহ.) মাযহাব। আর তা হল, এমন ব্যক্তি ( যে ব্যক্তি জমিনের উপর সিজদা করতে অক্ষম) যদি দাড়িয়ে নামায আদায় করতে সক্ষম হয় তাহলে তাকে দাড়িয়েই নামায আদায় করতে হবে। আর যেহেতু সে সিজদা করতে অক্ষম তাই সে ইশারায় সিজদা করবে (যদি রুকু করতেও অক্ষম হয় তাহলে রুকুও ইশারায় আদায় করবে)। জমিনে সিজদা করতে অক্ষম হওয়ার কারণে দাড়ানোর ফরয ছাড়া যাবে না।
মুফতী মুহাম্মাদ তাকী উসমানী দামাত বারাকাতুহুম দালায়েলের আলোকে এই ‘কওল’ (বক্তব্য)-কেই শক্তিশালী বলেছেন যে, কিয়ামের ফরয আদায় থেকে শুধু ঐ ব্যক্তি ছাড় পাবে যে দাড়িয়ে নামায আদায় করতে অক্ষম। সিজদা করতে অক্ষম হওয়ার কারণে কিয়াম-এর ছাড় পাবে না। তিনি সেখানে বিশদভাবে ঐ কথারও খন্ডন করেছেন যে, শুধু সিজদার জন্য কিয়াম ফরয করা হয়েছে। তাই সিজদা করতে অক্ষম হলেই কিয়াম জরুরী থাকে না। তিনি একাধিক দলীল দ্বারা এ কথা প্রমাণ করেছেন যে, কিয়াম নামাযের একটি স্বতন্ত্র ফরয তা শুধু সিজদার জন্য নয়।
এমন কি হযরত মাওলানা মুহাম্মাদ তাকী উসমানী দামাত বারাকাতুহুম তার ফতওয়ায় এ কথাও লিখেছেন যে, যে ব্যক্তি দাড়িয়ে নামায শুরু করতে পারে কিন্তু সিজদার জন্য জমিনে বসার পর আবার দাড়াতে তার অনেক কষ্ট হয়, এমন ব্যক্তিও কিয়াম (দাড়িয়ে নামায পড়া) একেবারে ছাড়বে না। বরং প্রথম রাকাত দাড়িয়ে আদায় করবে। এরপর দাড়াতে কষ্ট হওয়ার কারণে বাকী নামায বসে আদায় করবে।
এর সাথে সাথে হযরত দামাত বারাকাতুহুম এ বিষয়টি অত্যন্ত স্পষ্টভাবে বলেছেন যে, জমিনের উপর সিজদা করতে অক্ষম কোন মুসল্লী যদি ফিকহে হানাফীর প্রসিদ্ধ মত অনুযায়ী আমল করে এবং পুরা নামায বসে আদায় করে এবং ইশারায় রুকু সিজদা করে তাহলে তার নামায ফাসেদ হয়েছে বলব না। কারণ, গায়রে মুজতাহিদের (মুজতাহিদ নয় এমন) জন্য মুজাতাহিদের ‘কওল’ও (বক্তব্য) দলীলে শরয়ী। সুতরাং যে ব্যক্তি সে অনুযায়ী আমল করেছে আমরা বলব না তার নামাজ ফাসেদ হয়েছে। (দেখুন : আল কাউসার)
প্রশ্ন: আজকাল চেয়ারে বসে নামায পড়ার প্রবণতা খুব বেশি দেখা যাচ্ছে। অনেক মানুষ তো শুধু আরামের জন্য চেয়ারে বসে নামায আদায় করেন। আবার কিছু মানুষ যদিও তাদের রুকু সিজদা করতে কষ্ট হয়, কিন্তু জমিনে বসে ইশারায় রুকু সিজদা করতে পারেন। তা সত্ত্বেও তারা নির্দ্বিধায় চেয়ারে বসে নামায আদায় করেন।
আমার প্রশ্ন হল, শুধু আরামের জন্য চেয়ারে বসে নামায আদায় করা কি ঠিক? যদি কেউ তা করে তার নামায কি সহীহ হবে? আর যে ব্যক্তি জমিনে বসে নামায আদায় করতে পারে তার জন্য কি শুধু এই ওযরে চেয়ারে বসে নামায আদায় করা সহীহ হবে যে, সে রুকু সিজদা করতে সক্ষম নয়?
আশা করি বিষয়গুলো স্পষ্টভাবে জানাবেন।
উত্তর : যে ব্যক্তি শুধু আরামের জন্য অথবা মামুলি কষ্টের বাহানায় চেয়ারে নামায আদায় করছেন তিনি মস্ত বড় ভুল কাজ করছেন। এভাবে নামায আদায় করার দ্বারা তার নামাযই হবে না। তার উপর ফরয, দাড়িয়ে নামায আদায় করা এবং যথা নিয়মে রুকু সিজদা আদায় করা।
আর যে ব্যক্তি জমিনের উপর বসে নামায আদায় করতে সক্ষম তার জন্য শুধু এই বাহানায় চেয়ারে বসে নামায আদায় করা ঠিক নয় যে, সে দাড়িয়ে নামায আদায় করতে বা রুকু সিজদা করতে অক্ষম। বরং এ ধরণের লোকেরা জমিনে বসে নামায আদায় করবে। চেয়ারে বসে নামায আদায় করবেন শুধু ঐ লোকেরা যারা জমিনে বসে নামায আদায় করতে অক্ষম।
হযরত মাওলানা মুহাম্মাদ তাকী উসমানী দামাত বারকাতুহুম তার সদ্য লেখা এক ফতওয়ায় চেয়ারে বসে নামায আদায় করার ক্ষতির দিকগুলো আলোচনা করতে গিয়ে বলেন, ‘জমিনে বসে নামায আদায় করার শক্তি থাকা সত্ত্বেও চেয়ারে বসার যে প্রচলন দেখা যায় তাতে বিভিন্ন দিক থেকে আপত্তি রয়েছে।
১. মাযুর ব্যক্তিদের জন্য জমিনে বসে নামায আদায় করাই উত্তম ও মাসনূন তরীকা। এর উপরই সাহাবায়ে কেরাম রাযিয়াল্লাহু আনহুম এবং পরবর্তীদের আমল চলে আসছে। চেয়ারে বসে নামায আদায় করার রেওয়াজ কেবল শুরু হয়েছে। খায়রুল কুরূনে এর নযীর নেই। অথচ সে যুগে মাযুরও ছিল চেয়ারও ছিল।
২. যে ব্যক্তি শরীয়তের দৃষ্টিতে মাযুর নয়, অর্থাৎ কিয়াম, রুকু সিজদা করতে সক্ষম, তার জন্য জমিনে বা চেয়ারে বসে ফরয এবং ওয়াজিব নামায আদায় করাই জায়েয নেই। অথচ কখনো কখনো দেখা যায় এ ধরণের সুস্থ ব্যক্তিও সামনে চেয়ার পেয়ে চেয়ারে বসে নামায আদায় করে নেয়। ফলে তার নামাযই হয় না।
৩. চেয়ারের ব্যবহারের কারণে কাতার সোজা করা ও সোজা রাখার ক্ষেত্রে অনেক সমস্যার সৃষ্টি হয়। অথচ মিলে মিলে দাড়ানো ও কাতার সোজা করার বিষয়ে হাদীস শরীফে জোর তাকীদ এসেছে।
৪. বিনা প্রয়োজনে মসজিদে চেয়ারের অধিক্যের কারণে তা নাসারাদের গির্জা ও ইহুদীদের উপাসনালয়ের সাদৃশ দেখা যায়। তারা গির্জায় চেয়ার ও বেঞ্চে বসে উপাসনা করে। আর দ্বীনী বিষয়ে ইহুদী নাসারা ও অন্যান্য জাতির সাদৃশ্য থেকেহ নিষেধ করা হয়েছে।
৫. নামায তো এমন ইবাদত যা আদায় করতে হয় বিনয়াবনত হয়ে বিগলিতচিত্তে। আর চেয়ারে বসে নামায আদায় করার চেয়ে জমিনে বসে নামায আদায়ের মাঝে তা পূর্ণমাত্রায় পাওয়া যায়।
৬. কোন কোন যুবক ও সুস্থ ব্যক্তি নামাযের পর মসজিদে রাখা চেয়ারে বসে আরাম করে। কখনো কখনো চেয়ার নিয়ে গোল হয়ে বসে আলাপচারিতায় লিপ্ত হয়। এটা মসজিদের পবিত্রতা, মার্যাদা ও আদবের খেলাফ।
৭. মসজিদে চেয়ারের ব্যবহারের কারণে কোন কোন ছুরতে কুরআনে কারীম এবং মুরববী নামাযীদের আদব ও এহতেরামের ব্যত্যয় ঘটে।’’
(নমুনা স্বরূপ আপত্তির এ সাতটি দিক উল্লেখ করার পর হযরত লেখেন 🙂
اس لئے اشارہ سے نماز پرهنے كے لئے بهى حتى الامكان كرسيوں كے استعمال سے بچنا چاہئے اور ان كے استعمال كى حوصلہ شكنى كرنى چاہئے، اور ان كا استعمال صرف ان حضرات كى حد تك محدود كرنا چاہئے جو زمين پر بيٹهكر نماز ادا كرنے پر قادر نہ ہوں.
‘‘…এ জন্যই ইশারায় নামায আদায় করার জন্যও যথাসম্ভব চেয়ারের ব্যবহার না করা চাই। চেয়ার ব্যবহারের প্রতি নিরুৎসাহিত করা চায় এবং এর ব্যবহার কেবলমাত্র ঐ সকল ব্যক্তির মাঝে সিমাবদ্ধ করা উচিত, যারা জমিনে বসে নামায আদায় করতে সক্ষম নয়।’’
এই স্পষ্ট বক্তব্য সত্ত্বেও হযরত আবার এটাও লিখেছেন যে, রুকু সিজদা করতে অক্ষম ব্যক্তিগণ জমিনের উপর বসে ইশারায় নামায আদায় করতে সক্ষম হওয়ার পরও যদি চেয়ারে বসে নামায আদায় করে থাকেন, তাহলে সেটাও জায়েয, কিন্তু অনুত্তম কাজ। আর দারুল উলূম দেওবন্দের ফতওয়ায় এটাকে শুধু অনুত্তমই বলা হয়নি বরং বলা হয়েছে, তা বিভিন্ন কারণে ‘কারাহাত’ মুক্ত নয়।
আমাদের দেশের বিভিন্ন দারুল ইফতার ফতওয়াও এটাই। মারকাযুদ দাওয়ার দারুল ইফতার ফতওয়াও এটাই যে, রুকু সিজদায় অক্ষম ব্যক্তিগণ জমিনে বসতে সক্ষম হলে তাদের জন্য চেয়ারে বসে নামায আদায় করা মাকরূহ। যা পরিহার করা জরুরী। আর রুকু সিজদায় সক্ষম ব্যক্তি যদি এমনটি করে তাহলে তো তার নামাযই শুদ্ধ হবে না।
মোদ্দাকথা এই যে, যে ব্যক্তি দাড়িয়ে নামায আদায় করতে অক্ষম তার জন্য বিকল্প পদ্ধতি হল, জমিনে বসে তা আদায় করা। আর যে রুকু সিজদা করতে অক্ষম তার জন্য বিকল্প পন্থা হল, ইশারায় তা আদায় করা। আর যে ব্যক্তি যমিনে বসে নামায আদায় করতে অক্ষম তার জন্য বিকল্প হল, চেয়ারে বসে নামায আদায় করা। কেবলমাত্র প্রথম ও দ্বিতীয় ওযরের কারণে চেয়ারে বসে নামায আদায় করা ঠিক নয়। (দেখুন : আল কাউসার)