হযরত সোলায়মান (আঃ) ও সাবার রাণী

একদা হযরত সোলায়মান (আঃ)-এর দরবার স্বীয় প্রভাব প্রতিপত্তি ও জাঁকজমকের সাথে অনুষ্ঠিত হয়ে চলছিল। এ সময় তিনি জানতে পারলেন, “হুদহুদ” পাখীটি দরবারে অনুপস্থিত। তিনি বললেন, হুদহুদ পাখীটিকে যে দরবারে দেখতে পাচ্ছি না। যদি সে প্রকৃতই গ্রহনযোগ্য কোন কারণ ব্যতীত অনুপস্থিত হয়ে থাকে, তাহলে তার এ অপরাধ শাস্তিযোগ্য। এ অপরাধে আমি হয়তো তাকে কঠিন শাস্তি দিব অথবা জবাই করে ফেলব। নতুবা সে নিজের অনুপস্থিতির যৌক্তিক কোন কারণ পেশ করবে। কিছুক্ষণের ব্যবধানে হুদহুদ পাখিটি উপস্থিত হয়ে সুলায়মান (আঃ)-এর জিজ্ঞাসাবাদের জবাবে বলল, আমি এক সংবাদ নিয়ে এসেছি, যার ব্যপারে আপনি অবগত নন। তা হলো, ‘ইয়ামান’ এলাকায় সাবা সম্প্রদায়ের এক রানী রয়েছেন। আল্লাহ তা’য়ালা তাকে সব কিছু দিয়েছেন। সুখ-সমৃদ্ধি, আরাম-আয়েশ তথা বিলাসী জীবন যাপনের প্রয়োজনীয় কোন দ্রব্য সামগ্রীই তার অভাব নেই। তার রাজসিংহাসন স্বীয় বৈশিষ্ট্যে অত্যন্ত বৈশিষ্ট্যময়-জাঁকজমকপূর্ণ। সাবার রাণী ও তার সম্প্রদায় সূর্যপূজক। শয়তান তাদেরকে পথভ্রষ্ট করে রেখেছে। তাই তারা সমগ্র সৃষ্টি জগতের ¯্রষ্টা, বিশ্বপালক, এক-একক, লা শারীক আল্লাহর ইবাদত করে না।
‘হুদহুদ’ পাখীর এ ঘটনার উল্লেখে আল্লাহ তা’য়ালা কোরআন মাজিদে ইরশাদ করেন-ঃ
وتفقد الطير فقال مالي لاارالهدهد ام كان من الغائبين- لاعذبنه عذابا شديدا اولاذبحنه او لياتيني بسلطان مبين- فمكث غير بعيد فقال احطت بما لم تحط به وجئتك من سبا بنبا يقين-
অর্থঃ এবং সোলায়মান (আঃ) পক্ষীদের খোঁজ-খবর নিলেন, অতঃপর বললেন; কি ব্যাপার, হুদহুদ পাখিটিকে যে দেখছি না, নাকি সে কোথাও অদৃশ্য হয়ে গেল? আমি তাকে কঠোর শাস্তি দেব অথবা জবাই করে ফেলব, নয়তো সে আমার নিকট কোন সুস্পষ্ট প্রমান উপস্থাপন করবে। অনন্তর কিছুক্ষণ পরেই হুদহুদ উপস্থিত হল, এবং বলল, আমি এমন বিষয় অবগত হয়ে এসেছি, যা আপনি অবগত নন। এবং আমি আপনার নিকট সাবা সম্প্রদায়ের সুনিশ্চিত সংবাদ এনেছি। (সূরা- নামল, আয়াত ঃ ২০,২১,২২)
স্বভাবতই প্রশ্ন জাগে, সোলায়মান (আঃ) হঠাৎ করে হুদহুদ পাখীর খোঁজ নিলেন কেন?এ প্রশ্নের উত্তরে কয়েকটি মতামতই পরিলক্ষিত হয়। কেউ কেউ বলেন- হযরত সোলায়মান (আঃ) নিয়মিত নিজবাহিনীর খোঁজ-খবর নিতেন। এরই অংশ হিসাবে হুদহুদের খোঁজ পড়ে। বিশেষত সংখ্যায় কম এবং দৈহিকভাবে দুর্বল, এমন শ্রেণীর খোঁজ খবরই তিনি একটু বেশি রাখতেন। তার বাহিনীতে হুদহুদ পাখীর সংখ্যাও কম এবং দৈহিক ভাবেও তারা ক্ষুদ্র-দুর্বল প্রজাতির, তাই বিশেষ ভাবে এদেরেই খোঁজ খবর নিতেন।
কেউ কেউ বলেন, সোলায়মান (আঃ) এর দরবারে যখন হুদহুদ পাখীর খোঁজ পড়ে তখন এক প্রান্তরে দরবার অনুষ্ঠিত হচ্ছিল। এসময় পানির খোঁজ নেওয়ার জন্য হুদহুদের প্রয়োজন পড়ে। কেননা, এই পাখিটি ভূমির অতি গভীরে পানি থাকলেও খোঁজ দিতে পারত। সোলায়মান (আঃ) পানির খোঁজ নেওয়ার জন্য হুদহুদকে না পেয়ে মর্মাহত হন। তিনি ধারণা করলেন, পশুপক্ষিসহ সমগ্র জীবকুলকে আল্লাহ তা’য়ালাই তার অধীনস্থ করে দিয়েছেন। এটা তাঁর প্রতি আল্লাহর বিশেষ অনুগ্রহ। এখন হয়ত আমার কোন ত্রুটির কারণে সেটি অনুপস্থিত। এ ধারণাবশতঃ তিনি চিন্তা করে দেখলেন, আল্লাহ প্রদত্ত অনুগ্রহে কোন প্রকার অমর্যাদা হতে পারে, এমন কোন কর্ম তাঁর দ্বারা সংঘটিত হয় নি তো। তখনই তিনি বলে উঠলেন, অনুমতি ব্যতিরেকে অনুপস্থিত থাকা মহা অন্যায়। সুতরাং হয়ত হুদহুদ অনুপস্থিতির যুক্তি সঙ্গত কোন কারণ ব্যখ্যা করবে নয়ত আমি তাকে হত্যা করব। এসব কথা শেষ হতে না হতেই ‘হুদহুদ’ এসে সাবার রানীর কথা বিবৃত করে। সে সাবার রাণী এবং তার সম্প্রদায় সম্পর্কে বলল যে, তারা সূর্যের পূজক। শয়তান তাদেরকে পথভ্রষ্ট করে আল্লাহর ইবাদত হতে বিমুখ করে রেখেছে।
সোলায়মান (আঃ) প্রথম দিকে হুদহুদের বক্তব্যকে আত্মরক্ষার কৌশল বলে ভাবলেন। তাই তিনি বললেন, তোমার কথিত সাবা সম্প্রদায় ও তথাকার রাণীর বিষয়ে সত্য-মিথ্যার পরীক্ষা এক্ষুণি হয়ে যাবে। নিজ বক্তব্যে সত্যবাদী হলে তুমি আমার এ চিঠি নিয়ে সাবার রাণীকে পৌঁছে দাও এবং এ চিঠি সম্পর্কে তারা কি বলাবলি করে তা শুন। হুদহুদ হযরত সোলায়মান (আঃ) এর চিঠি বহন করে নিয়ে সাবার রাণীর কোলের উপর ফেলে দেয়। রাণী তা পাঠ করে মর্ম অবগত হন এবং নিজ দরবারের সভাসদদেরকে বললেন, আমার নিকট একখানা সম্মানিত পত্র এসেছে। এই বলে তিনি পত্র প্রেরকের পরিচয় এবং পত্রের বিষয়বস্তু সংক্ষিপ্তাকারে বর্ননা করেন। হযরত সোলায়মান (আঃ) এর প্রেরিত এ পত্র এবং পত্রের প্রাপক সাবার রাণীর বক্তব্য সম্পর্কে আল্লাহ তা’য়ালা আল-কোরআনুল কারীমে ইরশাদ করেন:
قالت يايها الملؤا اني القي الي كتب كريم- انه من سليمن وانه بسم الله الرحمن الحيم ان لاتعلوا علي واتوني مسلمين-
অর্থঃ (পত্র প্রাপ্ত হয়ে) সে (রাণী)বলল, হে সভাসদবৃন্দ! আমার নিকট একখানা সম্মানিত পত্র নিক্ষিপ্ত হয়েছে। এ পত্র ‘সোলায়মানের’ পক্ষ হতে এবং তাতে রয়েছেঃ বিসমিল্লাহির রাহমানির রাহীম; তোমরা আমার মোকাবেলায় অহংকার কর না এবং আমার নিকট আস অনুগত হয়ে।
(সূরা ঃ নামল, আয়াত ঃ ৩০)
রাণী সভাসদদেরকে পত্রের বিষয়বস্তু অবহিত করে তার করণীয় সম্পর্কে পরামর্শ চাইলেন। তার সভাসদদের পরামর্শ কামনা এবং তাদের বক্তব্য কোরআন মাজীদে বিবৃত হয়েছে। এসম্পর্কে আল্লাহ তা’আলা এরশাদ করেনঃ
قالت يايها الملئوا افتوني في امري ما كنت قاطعة امرا حتي تشهدون- قالوا نحن اولوا قوة والوا باس شديد و الامر اليك فانظري ماذا تامرين-
অর্থঃ সে (রানী) বলল, হে পরিষদবর্গ! এ ব্যাপারে তোমরা আমাকে পরামর্শ দাও, আমি কোন বিষয়ে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত গ্রহণ করিনা যতক্ষণ না তোমরা আমার সম্মুখে উপস্থিত হও। তারা বলল, আমরা খুবই শক্তি শালী এবং যুদ্ধে পারদর্শী, আর (সিদ্ধান্ত গ্রহণের) অধিকার তো আপনারই, সুতরাং যা কিছু আদেশ করতে হয় আপনিই স্থির করুন। (সূরা, নামল. আয়াত: ৩২-৩৩, পারা ১৯)
সাবার রাণীর পরামর্শ কামনার জবাবে তার সভাসদরা বলল, দেখুন, ভীত হবার কোন কারণ নাই। কেননা আমরা কোন দুর্বল জাতি নই, আর যুদ্ধবিদ্যা সম্পর্কেও অপারদর্শী নই। প্রয়োজনে পত্র প্রেরকের মুখোমুখি হবার শক্তি সামর্থ্য আমাদের রয়েছে। অবশিষ্ট রইল এতদাসংক্রান্ত পরামর্শের ব্যাপার। এ ব্যাপারে আপনিই সর্বময় ক্ষমতার অধিকারী। সুতরাং যা আদেশ হয় করুন। পারিষদদের জবাবে রাণী বললেন, অবশ্যই আমরা শক্তিশালী, প্রভাব প্রতিপত্তির অধিকারী। মোকাবেলার সামর্থও আমাদের রয়েছে, এটা যথার্থ। কিন্তু সোলায়মান (আঃ) এর ব্যাপারে আমাদের ত্বরিত কোন সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা উচিত হবে না। কোন প্রকার সিদ্ধান্ত গ্রহণের পূর্বে আমাদের তাঁর শক্তিসামর্থ ও প্রভাব প্রতিপত্তি সম্পর্কে সুস্পষ্ট ধারণা অর্জন করা প্রয়োজন। কেননা যে আজব পন্থায় সোলায়মান (আঃ) পত্র আমাদের পর্যন্ত পৌছেছে, তা আমাদেরকে এ শিক্ষাই দিচ্ছে যে, তাঁর সম্পর্কে ভেবে-চিন্তে, বুঝে-শুনে পদক্ষেপ গ্রহণ করা সমীচীন। এরপর রাণী কি করতে যাচ্ছেন তার বর্ণনা দিয়ে বললেন, আমি ইচ্ছা করছি তার দরবারে কয়েকজন দূত প্রেরণ করব। তারা সোলায়মান (আঃ) এর জন্য মহামুল্যবান উপহার সামগ্রী নিয়ে যাবে। প্রেরিত দূতরা উপহার সামগ্রী বহন করে নিয়ে যাবার ছলে সোলায়মান (আঃ) এর শক্তিমত্তা ও প্রভাব প্রতিপত্তির সম্পর্কে একটা ধারণা করতে পারবে এবং আমাদের কাছে তাঁর কাম্য বিষয় কি সে সম্পর্কেও অবগতি লাভে সক্ষম হবে। যদি তিনি অসীম শক্তিমত্তা ও প্রভাব পরাক্রমের অধিকারী বাদশাহ হয়ে থাকেন, তবে তাঁর সাথে সম্মুখসমরে অবতীর্ণ হওয়া নিরর্থক। কেননা প্রভাব, পরাক্রম ও শক্তিমত্তার অধিকারী বাদশাহর রীতি হচ্ছে, তারা বিজয়ীর বেশে কোন জনবসতিতে প্রবেশ করলে সে জনবসতিকে উজাড় বরবাদ করে ছাড়ে এবং তথাকার সম্মানী নাগরীকদেরকে অপমান অপদস্থ করে। সুতরাং এরূপ ক্ষতি বরণ করে নেবার কি প্রয়োজন। সাবার রাণীর উল্লিখিত আলোচনা কোরআন মাজীদে বিবৃত হয়েছে, আল্লাহ বলেনঃ-
قالت ان الملوك اذا دخلوا قرية افسدوها وجعلوا اعزة اهلها اذلة وكذالك يفعلون- واني مرسلة اليهم بهدية فنظرة بم يرجع المرسلون-
অর্থ: সে (সাবার রাণী) বলল, রাজ্যাধিপতিগণ যখন কোন জনপদে প্রবেশ করে তখন, সে জনপদকে উজাড় করে দেয়। আর তথাকার সম্মানী সম্ভ্রান্ত নাগরিকদেরকে অপমানিত অপদস্থ করে, এবং এরাও তেমনিই করবে। আর আমি তাদের নিকট কিছু উপহার পাঠাচ্ছি, অনন্তর দেখব প্রেরিতরা কি নিয়ে আসে। (সূরা, নামল. আয়াত, ৩৪-৩৫, পারা.১৯)
কোরআন কারীমে সাবার রাণীর নাম উল্লিখিত হয় নাই। তাফসীরবিদ মনীষীদের বর্ণনাসূত্রে তাঁর নাম বিলকীস বলে জানা যায়। তাদের সকলেই তাঁর নাম বিলকীস বলে উল্লেখ করেছেন। সুতরাং এটা সর্বসম্মত ও সর্বজনস্বীকৃত।

This entry was posted in কোরআনের গল্প. Bookmark the permalink.
//