হযরত মূসা (আঃ) শুভ জন্মের ঘটনা

হযরত আব্দুল্লাহ ইবনে আব্বাস (রাঃ)- বর্ণনা করেন, যখন হযরত মূসা (আঃ) এর জন্মগ্রহনের সময় হলো তখন তাঁর মাতা একজন দাত্রীকে ডাকলেন। এই দাত্রী সেই দাত্রীদের অন্যতম, যাদেরকে ফেরাউনের লোকেরা নিযুক্ত করে রেখেছিল। যে বাড়িতে কোনো শিশুর জন্ম হতো, তাদের কাজ ছিল ফেরাউনের লোকদেরকে নবজাত শিশুর জন্মের সংবাদ দেওয়া। এ খবরের ভিত্তিতেই ফেরাউনের ঘাতক বাহিনী এসে নবজাত শিশুকে হত্যা করতো। কিন্তু এ ধাত্রীটির সঙ্গে মূসা (আঃ) এর জননীর অন্তরঙ্গতা ছিল। যথাসময়ে প্রসব বেদনা আরম্ভ হলে তাকে ডাকা হয়। সে আসলে হযরত মূসা (আঃ) এর -মাতা তাকে বলেন, আমার যে এ অবস্থা, তা তুমি জান, তবে তোমার বন্ধুত্বের দ্বারা আমি উপকৃত হতে চাই, ধাত্রী তার দায়িত্ব পালন করলো। হযরত মূসা (আঃ) এর মায়া মহাব্বত দ্বারা তার অন্তর পরিপূর্ণ হলো। তখন ধাত্রীর হাতে হযরত মূসা (আঃ) জন্ম গ্রহণ করলেন। ধাত্রী তাকে কোলে নিলো। মূসা (আঃ)-এর চক্ষুদ্বয়ের মাঝখান দিয়ে একটি নূর বের হয়। এ দৃশ্য দেখে ধাত্রী অত্যন্ত বিস্মিত হলো, তার দেহের প্রতিটি অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ কম্পমান হলো। আর হযরত মূসা (আঃ) এর মায়া মহাব্বত দ্বারা তার অন্তর পরিপূর্ণ হলো। তখন ধাত্রী হযরত মূসা (আঃ) এর মাকে বলল, আমাকে যখন ডাকা হয় এবং আমি তোমার নিকট আসি, তখন আমার পিছনে তোমার সন্তানের ঘাতকরা ছিল। অর্থাৎ, আমার ইচ্ছা ছিল জন্ম হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে শিশুটিকে ঘাতকদের হাতে অর্পণ করবো; কিন্তু এখন আমার অন্তরে তোমার সন্তানের জন্য এমন মায়া সৃষ্টি হয়েছে যে, জীবনে এমন মায়া আমি কারো জন্য উপলব্ধি করিনি। এজন্যে আমি বলছি, তোমার পুত্রের হেফাজত করো! এরপর যখন ধাত্রী হযরত মূসা (আঃ) এর গৃহ থেকে বের হচ্ছিল তখর ফেরাউনের একজন গোয়েন্দা তাকে দেখে ফেলেছিল। তারা সঙ্গে সঙ্গে সেই গৃহদ্বারে উপস্থিত হলো এবং ঘরে প্রবেশ করতে চাইলো। তখন হযরত মূসা (আঃ) এর ভগ্নি দ্রুত এসে তার মাতাকে খবর দিল যে সৈন্যবাহিনী এসে পড়েছে এবং তারা ভিতরে প্রবেশ করতে চায়। তখন হযরত মূসা (আঃ) এর বোন তাকে কাপড়ে জড়িয়ে চুলোয় নিক্ষেপ করলো, সে বুঝতেই পারেনি যে সে কি করছে। এরই মধ্যে সৈন্যরা ভিতরে প্রবেশ করলো, চুলোয় আগুন জ্বলছিল হযরত মূসা (আঃ) এর মাতার চেহারায় কোনো ভাবান্তর হলো না। সৈন্যরা জিজ্ঞাস করলো, ধাত্রী কেন এখানে এসেছিল ? তিনি বললেন সে আমার বান্ধবী, আমার সাথে দেখা করতে এসেছিল। এরপর তারা ফিরে গেল। তখন চুলোর কাছে গিয়ে মা দেখলেন, এরই মধ্যে চুলোর আগুন নিভে গেছে এবং শিশু মূসা নিরাপদে রয়েছেন, তিনি তাকে কোলে তুলে নিলেন।
কিছু দিন ফেরাউনের সৈন্যরা ঘরে ঘরে শিশু সন্তানের অনুসন্ধান করতে লাগল, তখন তিনি তার পুত্রের ব্যাপারে ভীত হয়ে পড়লেন। ঐ সময় আল্লাহ পাক তার অন্তরে ইলহাম করলেন যে শিশুটিকে একটি কাষ্ঠ নির্মিত বাক্সে রেখে নীলনদে ভাসিয়ে দাও। এ ঘটনার বিবরণ পবিত্র কুরআনে এভাবে বিকৃত হয়েছে-
অর্থ- আমি মূসা-জননীর নিকট এ প্রত্যাদেশ করলাম যে, তাকে সাগরে নিক্ষেপ কর, তথা নীলনদে ভাসিয়ে দাও। হযরত মূসা আঃ এর মাতার অন্তরে এ ধারনা আসার সঙ্গে সঙ্গে তিনি এক কাঠ মিস্ত্রিকে বাক্স তৈরীর নির্দেশ দিলেন। লোকটি বলল, এমন বাক্সের তোমার কি প্রয়োজন? তখন মূসা (আঃ)-এর জননী মিথ্যা বলেননি। তিনি জবাব দিলেন, আমার একটি শিশু সন্তান রয়েছে, তাকে এর মধ্যে লুকিয়ে রাখব। কাঠ মিস্ত্রি জিজ্ঞেস করল, লুকিয়ে রাখবে কেন?
তিনি বললেন, ফেরাউনের সৈন্যদের ভয়ে। যাহোক, তিনি বাক্সটি নিয়ে রওয়ানা হলেন। এদিকে মিস্ত্রি সৈন্যদের নিকট এ খবর দেওয়ার জন্য হাজির হলো। সে কিছু বলতে চাইল; কিন্তু আল্লাহ পাক তার বাকশক্তি ছিনিয়ে নিলেন। এরপর সে হাতের ইশারায় কিছু বুঝাতে চাইল; কিন্তু যখন সে তাতেও ব্যর্থ হলো তখন সৈন্যদের সরদার তাকে পিঠিয়ে বের করার নির্দেশ দিল। যখন সে তার স্থানে প্রত্যাবর্তন করল, তখন আল্লাহ পাক তার বাকশক্তি ফিরিয়ে দিলেন। আর সে পুনরায় সংবাদ পৌঁছানোর জন্য সৈন্যদের নিকট হাজির হলো। কিন্তু এবারও তার বাকশক্তি চলে গেল, তার দৃষ্টিশক্তিও চলে গেল। অবশেষে লোকেরা তাকে মেরে বহিষ্কার করে দিল। এখন সে চরম দুরবস্থার সম্মুখীন। হাঁটতে হাঁটতে সে একটি ময়দানে উপস্থিত হলো এবং মনে মনে এ নিয়ত করলো যে, যদি আল্লাহ পাক তার দর্শন ও বাকশক্তি ফিরিয়ে দেন তবে সে আর কখনো সেই শিশুর ব্যপারে গোয়েন্দাগিরী করবে না। আল্লাহ তার এ নিয়তের কারণে তার দর্শন ও বাকশক্তি ফেরত দিলেন। সে সঙ্গে সঙ্গে সিজদায় পড়ে গেল এবং দোয়া করল, হে আমার প্রতিপালক! আমাকে তোমার এই নেক বান্দার ঠিকানা জানিয়ে দাও। আল্লাহ পাক তাকে মূসা (আঃ)- এর ঠিকানা জানিয়ে দিলেন। সে তাঁর নিকট পৌঁছল এবং ঈমান আনলো। সে এ সত্য উপলব্ধি করলো যে, সবকিছু আল্লাহ পাকের পক্ষ থেকেই হয়েছে।
ওহাব ইবনে মুনাব্বিহ (রহ.) বর্ণনা করেছেন, হযরত মূসা (আঃ) এর মাতা যখন অন্তঃসত্ত্বা তখন তিনি তার অবস্থা গোপন রাখলেন। কেউ এ সম্পর্কে অবগত হলো না। যেহেতু আল্লাহ তা’য়ালা বনী ইসরাঈলের প্রতি ইহসান করতে ইচ্ছা করলেন, তাই তিনি পৃথিবীতে হযরত মূসা (আঃ)-এর আগমনের অবস্থাকে গোপন রাখলেন। এখানে উল্লেখ্য যখন বনী ইসরাঈলের অনেক পুত্র সন্তানকে হত্যা করা হলো, তখন ফেরাউনের জাতির পক্ষ থেকে এর প্রতিবাদ করা হয় এ মর্মে যে, যদি তাদের কে এভাবে হত্যা করা হয়, তবে অবশেষে আমরা গোলাম কোথায় পাবো। এবং পরিণামে আমাদেরকেই যাবতীয় কাজ করতে হবে। ফেরাউনের জাতি কিবতীদের পক্ষ থেকে উত্থাপিত এ দাবীর প্রেক্ষিতে ফেরাউন এ সিদ্ধান্ত গ্রহণ করলো, এক বছর বনী ইসরাঈলের পুত্র সন্তনদেরকে হত্যা করা হবে না, আর এক বছর করা হবে। যে বছর হত্যা না করার সিদ্ধান্ত ছিল সে বছর হযরত হারূন (আঃ) জন্ম গ্রহন করেছিলেন। আর যে বছর হত্যা করার সিদ্ধান্ত ছিল, সে বছরই হযরত মূসা (আঃ) এর জন্ম হল। যেহেতু ফেরাউনের লোকেরা বনী ঈসরায়েলের পুত্র সন্তনদের ব্যাপারে ধাত্রীদেরকে গোয়েন্দাগিরির কাজে ব্যবহার করে, তাই প্রতি মুহুর্তে ঘরে ঘরে অনুসন্ধান কার্য চলত। আল্লাহ পাক তাঁর বিশেষ রহমতে এ ব্যবস্থা করেছেন যে, হযরত মূসা (আঃ) এর মাতার দেহে কোনো পরিবর্তন লক্ষ্য করা যায়নি। যখন হযরত মূসা (আঃ) জন্ম গ্রহন করলেন, তখন তার ভগ্নি মারইয়াম ব্যতিত আর কেউ জানতেই পারল না। আল্লাহ পাক হযরত মূসা (আঃ) এর মাতার অন্তরে এ কথার ইলহাম করলেন যে, তুমি শিশু সন্তানটিকে দুধ পান করাতে থাক, যখন ফেরাউনের লোকদের তরফ থেকে কোনো প্রকার আশঙ্কা হয়, তখন তাকে নীল নদে ভাসিয়ে দিও। মূসা (আঃ) এর মাতা শিশু সন্তানটিকে তার কোলে লুকিয়ে দুধ পান করাতে থাকেন। শিশু মূসা কাঁদতেন না এমনকি, নড়াচড়াও করতেন না, কিন্তু এতদাসত্ত্বেও মূসা জননীর আশঙ্কা হল যে, ফেরাউনের লোকেরা যে কোন সময় আক্রমণ করতে পারে। তাই তিনি একটি সিন্দুক তৈরি করালেন। সিন্ধুকের মধ্যে শিশু সন্তানকে রেখে তাকে নীলনদে ভাসিয়ে দিলেন।
হযরত আব্দুল্লাহ ইবনে আব্বাস (রাঃ) বর্ণনা করেন, ফেরাউনের শুধু একটি কন্যা সন্তান ছিল, পুত্র সন্তান ছিল না। ঐ কন্যা সন্তানটিও শ্বেত রোগে আক্রান্ত ছিল, তার চিকিৎসার যাবতীয় ব্যবস্থা হওয়া সত্ত্বেও সে সুস্থ হয়নি। জাদুকররা বলেছিল, তার আরোগ্য লাভ করা সম্ভব হবে নীলনদের দিক থেকে। মানবাকৃতির কোনো প্রাণী এ নীলনদে পাওয়া যাবে, তার মুখের লালা যদি ব্যবহার করা যায়, তবে শ্বেতরোগগ্রস্ত এ কন্যাটি সুস্থ হবে। আর তা পাওয়া যাবে অমুক দিন সূর্য উদিত হওয়ার সময়। ঐ দিন ছিল সোমবার। ফেরাউন নীলনদের তীরে তার বসবাস স্থান তৈরি করালো, তার সাথে ছিল স্ত্রী আছিয়া বিনতে মোজাহেম। ফেরাউনের এ অসুস্থ কন্যাটিও ছিল। হঠাৎ একটি সিন্দুক ভাসমান অবস্থায় দেখা গেল, ফেরাউন আদেশ দিল ভাসমান বস্তুুটি নিয়ে আসতে, ক্ষণিকের মধ্যে তার পরিচালকরা সিন্দুকটি ফেরাউনের সামনে এনে রেখে দিল। তারা সিন্দুকটি খোলার চেষ্টা করল; কিন্তু ব্যর্থ হলো। পরে ফেরাউনের স্ত্রী আছিয়া কাছে আসলেন এবং তিনি সিন্দুকের ভিতর একটি নূর দেখতে পেলেন, যা অন্য কেউ দেখতে পারেনি।
যাহোক, তিনি সিন্দুকটি খুলে ফেললেন, যার ভিতর থেকে সুন্দর একটি ফুটফুটে শিশু শায়িত অবস্থায় পাওয়া গেল। যার চক্ষুদ্বয়ের মাঝখানে নূর চমকাচ্ছিল। আল্লাহ পাক তাঁর রিজিক তাঁর আঙ্গুল সমূহের মধ্যে দিয়ে দিয়েছিলেন, সে এ আঙ্গুল চুষে দুধ পান করতো, এ নিষ্পাপ শিশুটির প্রতি অসাধারণ ¯েœহমায়া আছিয়ার অন্তরে সৃষ্টি হলো, এমনকি ফেরাউনও তাকে ভালবাসতে লাগল। সিন্দুক থেকে শিশুটিকে বের করা হল, তার অসুস্থ কন্যা এসে পড়ল। সে এ নবজাত শিশুর মুখের লালা নিয়ে তার শ্বেতরোগগ্রস্থ দেহে মালিশ করল। সঙ্গে সঙ্গে সে সুস্থ হলো। ঐ কন্যা শিশুটিকে চুম্বুন করল এবং টান দিয়ে বুকে টেনে এনে আদর করল। পবিত্র কোরআনে এ ঘটনাটিকে এভাবে বর্ণনা করা হয়েছে-
অর্থ- “এরপর ফেরাউনের পরিবারের লোকজন তাকে উঠিয়ে নেয়, যাতে সে তাদের শত্রু এবং দুঃখের কারণ হয়”।
অর্থাৎ, ভবিষ্যতে হযরত মূসা (আ.) তাদের দুশমন হবেন এবং তাদের দুশ্চিন্তার করন হবেন। এরপর ইরশাদ হচ্ছেঃ-
অর্থাৎ-“ নিশ্চয় ফেরাউন, হামান এবং তাদের সৈন্যবাহিনী ভুল করেছিল।” আর তাদের ভুল প্রত্যেক ব্যপারেই ছিল, যেমন হযরত মূসা (আ.) জন্ম গ্রহন করবেন এই ভয়ে হাজার হাজার নিষ্পাপ শিশুকে তারা হত্যা করেছে। এটি ছিল তাদের মারাত্মক ভুল। দ্বিতীয়ঃ শিশু মূসাকে তারা নীলনদ থেকে তুলে নিয়েছে এবং নিজের বাড়িতেই লালান পালন করেছে, পরবর্তীকালে যা হবার তা হয়েছে।
কোনো কোনো ব্যাখ্যাকার এ আয়াতের ব্যাখ্যা করেছেন এভাবে, নিশ্চয় ফেরাউন এবং হামান ও তাদের সৈন্যবাহিনী ছিল অপরাধী। হাজার হাজার নিষ্পাপ শিশুকে হত্যা করার মতো বড় অপরাধ আর কি হতে পারে! আর এজন্যেই আল্লাহ পাক ফেরাউন ও তার সহযোগীদেরকে হযরত মূসা (আ.) এর দ্বারা শাস্তি দিয়েছেন এবং যে শিশু থেকে আত্মরক্ষার জন্যে হাজার হাজার শিশুকে ফেরাউন হত্যা করেছে, সেই শিশুটিকে আল্লাহ পাক তার বাড়িতে, তারই নাকের ডগায়, তারই দ্বারা লালন পালন করিয়েছেন। এটি নিঃসন্দেহে সর্বশক্তিমান আল্লাহ পাকের অনন্ত অসীম কুদরতের এক বিস্ময়কর নিদর্শন।

This entry was posted in কোরআনের গল্প. Bookmark the permalink.
//